• নেতা থেকে আম-জনতা :মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

    মুক্তিযুদ্ধের চেতনাঃ নেতা থেকে আম-জনতা
    স্বীকৃতি পাচ্ছেন সাড়ে তেরোশ ...
    মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্পর্কে সর্বস্তরের মানুষের বক্তব্যগুলি সংগ্রহ করা হয়েছে যথাক্রমে ১৯৯৬ ও ২০০২ সালে। প্রথমভাগে এ কাজের অংশ-বিশেষে সহায়তা করেছিলেন শাকিল কালাম। বক্তব্যদানকারীদের অনেকে এরমধ্যে গতায়ু হয়েছেন। অনেকে বেঁচে আছেন। কিন্তু তাদের রেখে যাওয়া বক্তব্য শাশ্বত। ‘জনগণের মুক্তিযুদ্ধ চেতনার স্বরূপ সন্ধান’ গ্রন্থে আমরা বক্তব্যগুলি মুদ্রিত করে রেখেছি। সৃজনকালের পক্ষ থেকে এই সংগ্রহ অব্যাহত থাকবে। এ কাজে কেউ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্পর্কে বক্তব্য ও তথ্য দিয়ে আমাদের সহায়তা করলে তা সাদরে গ্রহণ করে তাদের নাম-ঠিকানাসহ ‘গণবানীর সন্ধানে’র পাতায় প্রচার এবং উল্লিখিত গ্রন্থের পরবর্তী সংস্করণে প্রকাশিত হবে।
    কিছু লোকের অপকর্মের কারণে আজকাল ‘চেতনা’ শব্দটি নিয়ে কাউকে কাউকে ব্যঙ্গ করতে দেখি। সুযোগ পেয়ে এটি বেশি-বেশি করছে রাজাকার ও আওলাদে-রাজাকাররা। আওলাদ বলতে আমি রাজাকার-আলবদরদের ঔরসজাতদের শুধু নয়, এখনো যারা বাংলাদেশকে পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের মতো দেশে পরিণত করতে চায় সেই নব্যরাজাকার-আলবদরদের সবাইকেই বুঝি। এরা চেতনা শব্দটি কলুষিত করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অসাবধানতা বা রাগ-অভিমানবশত এটি যখন রাজাকার ও আওলাদে রাজাকার-বহির্ভূতদের মুখেও শুনি তখন খারাপ লাগে। এ দেশে কিছু লোক ধর্মের অপব্যাখ্যা করে অন্যায় কাজ করে। এখানে অপব্যবহারকারীই সমালোচনার পাত্র, ধর্ম নয়।
    যারা মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন-চেতনায় বিশ্বাস রাখেন বা এগুলিকে সর্বতোভাবে উর্ধে তুলে রাখতে চান তাদের সবারই চেতনা শব্দটাকে কলুষিত হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে এগিয়ে আসা উচিত। আওয়ামী লীগের বা তার সরকারের অনেক কাজের বিরুদ্ধে তাদের অনেকের সমালোচনা আছে বা থাকতেই পারে। কিন্তু সেই সমালোচনাটা দয়া করে মুক্তিযুদ্ধের ময়দানে দাঁড়িয়েই করুন, ময়দান ছেড়ে দিয়ে রাজাকার-আলবদরদের কাতারে গিয়ে নয়। মুক্তিযুদ্ধ যেমন আওয়ামী লীগের একার নয়, তেমনি চেতনা শব্দটিও আওয়ামী লীগের একার নয়। একজন লেখক হিসেবে আওয়ামী লীগের কঠোরতর সমালোচনা আমার চেয়ে বেশি কেউ করেছে কি না, আজও আমার চোখে পড়েনি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের গৌরব-চেতনার ময়দানে থেকেই যা করার করেছি ও করে যাব। এ কারণে কোনো-কোনো দল-মহল থেকে খারিজ হয়ে গেছি। তাতে আমার কিছু যায়-আসে না। আমার সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গা আমার পাঠক ও দেশের বিবেকবান মানুষ।
    গ্রন্থে অনেক লোকের যে-সব বক্তব্য নিয়েছি, সে-সবের অংশ-বিশেষ এখন থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রচার করব ‘গণবাণীর সন্ধানে’র পাতায়।
    ধন্যবাদান্তে,
    সৃজনকাল পরিবার।
    ১৯৮৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত হয়েছিল একটি ঐতিহাসিক সৌজন্য বিজ্ঞাপন। বিষয়: সংক্ষেপে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। প্রকাশ করা হয় মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্র-এর পক্ষে, যার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল কাজী নূর উজ্জামান বীরোত্তম ও শাহরিয়ার কবির । আমি, আহমেদ মূসা ছিলাম প্রকাশনা সম্পাদক । এই সংগঠন থেকেই প্রকাশিত হয়েছিল একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়সহ অনেক ঐতিহাসিক বাংলা-ইংরেজি গ্রন্থ। গণবানীর সন্ধানের পেজে ধারাবাহিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে উদ্ধৃতি প্রকাশের সঙ্গে বিজ্ঞাপনটি সাযুজ্যপূর্ণ বলে এখানে প্রকাশ করা হলো।
    একটা অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য এ দেশের জনগণ দীর্ঘদিন থেকেই লড়াই করছে। পাকিস্তান আমলে শাসকগোষ্ঠী এ দেশে ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকচেতনা সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল এর মাধ্যমে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে শোষণের।
    পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর সেই সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে যে অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি এ দেশের মানুষের মধ্যে দানা বেঁধেছিল সেটাই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। সেই চেতনাকে সামনে নিয়েই এ দেশের কোটি কোটি মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছির মুক্তিযুদ্ধে। স্বাধীন হয়েছিল দেশ, চারটি মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছিল সংবিধান।
    উৎসঃ শেখ হাসিনা; দৈনিক জনকণ্ঠ, ২৪ মার্চ ১৯৯৩।
    এ দেশের মানুষ যে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিল তার পেছনে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নই ছিল আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল চেতনা। মানুষ চেয়েছিল সবার জন্য সুন্দর ভবিষ্যৎ। সবাই ভালভাবে বেঁচে থাকবে। মানুষের খাওয়া-পরার অভাব হবে না। দেশে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে। সকল মানুষ কাজ পাবে। জনগণ ভোট দিয়ে যাদের নির্বাচন করবে, দেশ পরিচালনা করবে তারাই। সবাই অবাদে তার নিজের মত প্রকাশ করতে পারবে। দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যত বিকশিত হয়, মানুষের মেধা, কর্মক্ষমতা, উদ্ভাবনী শক্তির ততই বিকাশ ঘটে।
    উৎসঃ খালেদা জিয়া; ১৯৯৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর শিশু-কিশোর কুচকাওয়াজে দেওয়া ভাষণ।
    পুনর্মুদ্রণঃ আহমেদ মূসা সম্পাদিত জনগণের মুক্তিযুদ্ধ চেতনার স্বরূপ সন্ধান গ্রন্থে, পৃষ্ঠা - ১০৪
    ২. মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ছিল একটি গণতান্ত্রিক দেশ, আত্মনির্ভরশীল জাতি, দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ, মানুষের সঙ্গে মানুষের সীমাহীন বৈষম্য কমিয়ে আনা এবং গণমানুষের জীবন জীকিার উন্নয়ন। সব অঙ্গীকার আমরা আজও পালন করতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধের পরপরই শুরু হয় স্বপ্নভঙ্গের পালা। এক শ্রেণীর লোক নিজের দেশকে লুণ্ঠন করেছে বর্গীয় মতো। পরে চাপিয়ে দিয়েছে রাজনৈতিক হত্যাকান্ড, দুর্ভিক্ষ, একদলীয় শাসন যা ছিল মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নচেতনার বিরোধী। ... ১৬ ডিসেম্বরের পর এক শ্রেণীর লোকের মধ্যে ক্ষমতা ও বিত্ত লিপ্সার উল্লম্ফন ঘটে। তারা মুক্তিযুদ্ধেi স্বপ্ন-চেতানকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে। কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষ ও মধ্যবিত্তের সমৃদ্ধ জীবনের স্বপ্ন ধূলিস্মাৎ হয়ে গেছে তখনই। ... এদেশের খেটে খাওয়া গরীব মেহনতি মানুষের জন্য দরকারী অনেক কিছুই আজ পর্যন্ত করা যায়নি। স্বপ্ন অঙ্গীকারের যে অংশ আমরা আজ পর্যন্ত পূরণ করতে পারিনি, কাল তা আমরা অবশ্যই পারব ... আমি হতাশ নই; অত্যন্ত আশাবাদী। লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত, কোটি মানুষের বলীয়ান ত্যাগে সৃষ্ট বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে সম্মানের স্থান করে নেবেই।
    উৎসঃ আবদুল মান্নান ভূঁইয়া; দৈনিক ইত্তেফাক, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৯৫।
    ৩. কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
    আমাদের সব দুঃখ জমা দেবো যৌথ-খামারে,
    সম্মিলিত বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে সমান সুখের ভাগ
    সকলেই নিয়ে যাবো নিজের সংসারে।
    উৎসঃ হেলাল হাফিজ; একটি পতাকা পেলে, ১৩ ডিসেম্বর ১৯৮০।
    ৪. উপমহাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান অংশের বাসিন্দাদের ওপরে অব্যাহত ঔপনিবেশিক শাসন, শোষণা ও নির্যাতনের অবসান তথা বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা যার অধিবাসীরা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ভোগ করবে, কোন বিদেশী শক্তির ক্রীড়নক না থেকে। এটাই আমার চোখে মুক্তিযুদ্ধেও চেতনা।
    উৎসঃ মোহাম্মদ মোস্তফা
    গ্রাম: চোছনা, ডাক: মোহাম্মদ আলী বাজার, জেলা: ফেনী।
    ডিজিএম, বাংলাদেশ ব্যাংক। বয়স ১৯৭১ সালে: ২২ বছর।
    আহমেদ মূসা সম্পাদিত জনগণের মুক্তিযুদ্ধ চেতনার স্বরূপ সন্ধান, পৃষ্ঠা - ১৪০
    ৫. পাকিস্তানের পঁচিশ বছরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী, স্বাধিকার ও শোষণমুক্তির যে দীর্ঘ সংগ্রাম চলে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ তারই পরিণতি। এ সকল সংগ্রামের মধ্য দিয়ে উৎসারিত চেতনার সামাজিক প্রকাশই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এইচেতনা কোন ব্যক্তি বা দলের নয়। দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মুক্তিযুদ্ধে চেতনাকে সংজ্ঞায়িত করার যে কোন চেষ্টা তাই সঙ্কীর্ণ ও খন্ডিত হতে বাধ্য। পাকিস্তানের পঁচিশ বছরে এ সকল সংগ্রাম জনমনে ঐ সকল বিষয়ে যে আশার সৃষ্টি করে তা-ই তাদের অনুপ্রাণিত করেছে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে। ঐক্যবদ্ধ হতে। মুক্তিযুদ্ধ-উত্তরকালে জনগণ তারই বহিঃপ্রকাশ ও বাস্তবায়ন দেখতে চেয়েছে রাষ্ট্রীয় ও সমাজ জীবনে।
    উৎসঃ রাশেদ খান মেনন; দৈনিক জনকণ্ঠ, ২৪ মার্চ ১৯৯৩।
    ৬. সেদিন মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছিলাম। আজ বাঁচতে বাঁচতে মরছি প্রতিনিয়ত। আমি তবু আশাবাদী। মাটি ও পতাকা পেয়েছি। একদিন হয়তো সবই পাবো। আমি না পেলেও আমার সন্তান পাবে। এটা সত্য যে শাসক শোষক এখন আমাদের নিজের লোক। ৬ দফার মাধ্যমে বাঙালীর শাশ্বত মুক্তি চেতনার সাথে রাজনীতির সংযোগ ঘটে এবং তার ফলে মুক্তির অস্ফুট স্বপ্নটি সর্বজনীনতা লাভ করে। সর্বজনীন অংশগ্রহণে স্বাধীনতা অর্জিত হয় এবং কৃতিত্ব সবার। বাঙালীর শাশ্বত চেতনার উপরোক্ত ধারাটি এবং ষাট ও সত্তরের দশকের রাজনৈতিক অঙ্গনে উচ্চকিত দাবিসমূহ বিচার করলে অনিবার্যভাবে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হয় যে, রাজনৈতিকভাবে গণতন্ত্র, অর্থনৈতিকভাবে ন্যায়বিচার, সামাজিকভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাসহ উদার মানবতাবাদই ছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রচ্ছন্ন চেতনা - যা প্রাক যুদ্ধকালে আনুষ্ঠানিকভাবে সবার কাছে পরিপূর্ণরূপে প্রচার লাভ করতে পারেনি।
    উৎসঃ মোঃ আবুল কাসেম, মুক্তিযোদ্ধা।
    গ্রাম: চুনিয়া পটল, ডাক: গুনেরবাড়ী, থানা: সরিষাবাড়ি, জেলা: জামালপুর।
    যুগ্ম পরিচালক, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বয়স ১৯৭১ সালে: ২২ বছর।
    আহমেদ মূসা সম্পাদিত জনগণের মুক্তিযুদ্ধ চেতনার স্বরূপ সন্ধান, পৃষ্ঠা - ১৪১
    ৭. একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের আগে এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সবরকম বৈষম্যের শিকার হয়েছিল আপিত্যবাদী তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তার হাতে। সেই ঔপনিবেশিক নিগড় থেকে বেরিয়ে এসে হাজার বছরের ঐতিহ্যধারা বাঙালী জাতি এই বাংলার ভূখন্ডে একটি অসাম্প্রদায়িক, সুখী, সমৃদ্ধ, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়ে তুলবে, যেখানে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সকল ধর্মের মানুষ অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মুক্ত আবহাওয়ায় নিঃশ্বাস নিতে পারবে, সকলেই অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষার সুষম ব্যবস্থা থাকবে - এটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে, এই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলার মানুষ একদিন মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং দেশ স্বাধীন করেছিল।
    উৎসঃ জাহানারা ইমাম; দৈনিক জনকণ্ঠ, ২৪ মার্চ ১৯৯৩।
    ৮. বাঙালী জাতির জাতীয়তাকে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক তথা সার্বিক অর্থে বিকশিত করার লক্ষ্যে এবং বিশ্বের মানচিত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে উক্ত পরিচিতিকে তুলে ধরার চেতনায় আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। একজন সফল মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজের পরিচয়কে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী স্বাধীনদেশে পরিচিত করাই ছিলো আমার লক্ষ্য বা স্বপ্ন।
    উৎসঃ তেমিয় কুমার মুৎসুদ্দী, উপজাতি মুক্তিযোদ্ধা।
    গ্রাম: আবুরখিল, থানা: রাজান, জেলা: চট্টগ্রাম।
    ব্যাংক কর্মকর্তা, বয়স ১৯৭১ সালে: ১৮ বছর।
    আহমেদ মূসা সম্পাদিত জনগণের মুক্তিযুদ্ধ চেতনার স্বরূপ সন্ধান, পৃষ্ঠা - ১৪৩
    ৯. মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে আমি বুঝি বাঙালী জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র। এই চারটি মূলনীতির ওপর ভিত্তি করেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকারের শাসন ও শোষণ-এর নিগড় থেকে মুক্তিলাভের জন্যে সেদিন এদেশের জনসাধারণ ‘জয়বাংলা, তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’ এবং বীর বাঙালী অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’- এসব রণধ্বনি দিযে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। দুঃখের বিষয়, আজকাল জয়বাংলা, বাঙালী জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং মুক্তিযুদ্ধের এই বিষয়গুলো ক্রমশ নিষিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও আজ ভুলুণ্ঠিত।
    উৎসঃ শামসুর রাহমান; দৈনিক জনকণ্ঠ, ২৪ মার্চ ১৯৯৩।
    ১০. রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে মুক্তি, সর্বোপরি আমাদের জাতিসত্তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের যে উপাদানগুলোর কথা বললাম, সেগুলো যদি এসে যায় তাহলে আমাদের সব ধরনের মুক্তি অর্জিত হবে বলে বিশ্বাস ছিল। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত স্বপ্ন একাকার হয়ে গিয়েছিল। স্বপ্ন যতটুকু পূরণ হবার কথা ছিল তা এখনো পুরোপুরি হয়নি। বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের সার্বিক কর্মকান্ড বা উন্নয়নমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলে আমাদের স্বপ্নের পূর্ণ প্রতিফলন ঘটবে।
    উৎসঃ এ. কে. এম. মোয়াজ্জেম হোসেন
    গ্রাম: পাহারের চক, ডাক: নিশ্চিন্তপুর।
    মাঝারী ব্যবসায়ী। বয়স ১৯৭১ সালে: ২৮ বছর।
    আহমেদ মূসা সম্পাদিত জনগণের মুক্তিযুদ্ধ চেতনার স্বরূপ সন্ধান, পৃষ্ঠা - ১৪৪
    ১১. মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার কোন সুযোগ আছে বলে আমার মনে হয় না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে বোঝায় স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের চেতনা বাঙালীত্ব, সংসদীয় গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্র, অন্তত ন্যায়ভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেতনা। যখন আমরা একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছি, তখন আমরা মুক্তিযুদ্ধে চেতনা থেকে সরে গেছি। যখন আমরা ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়েছি ও ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করেছি, তখন আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিসর্জন দিয়েছি। যখন আমরা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের শাসন ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করেছি, তখন আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি।
    উৎসঃ আনিসুজ্জামান; দৈনিক জনকণ্ঠ, ২৪ মার্চ ১৯৯৩।
    ১২. স্বাধীনতাকে ঘিরে আমার বড় কোন স্বপ্ন বা এম্বিশন ছিল না। দেশের মানুষ খেয়ে-পরে, সুখে দিন কাটাবে, পাকিস্তানী আমলের চেয়ে উন্নত মানের জীবনযাপন করবে, আমাদের আর্থিক উন্নতি হবে, ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করার সুযোগ পাবে, তাদের খাদ্যের, চিকিৎসা এবং বাসস্থানের নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে। আর সবচেয়ে বড় স্বপ্নটি ছিল, স্বাধীন জাতি হিসেবে বাঙালীদের স্বাতন্ত্র্য বজায় থাকবে।
    উৎসঃ বাবু বিধু ভূষণ নাথ
    গ্রাম: ধর্মপুর, থানা: ফেনী, জেলা: ফেনী।
    শিক্ষক। বয়স ১৯৭১ সালে: ৩৬ বছর।
    আহমেদ মূসা সম্পাদিত জনগণের মুক্তিযুদ্ধ চেতনার স্বরূপ সন্ধান, পৃষ্ঠা - ১৪৫
    ১৩. মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন-চেতনা বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের কাছে ছিল বিভিন্ন রকম। তবে এরও বৃহত্তর রূপ আছে। সেটি হচ্ছে জাতিগত শোষণ, ঔপনিবেশি শোষণ, মানুষের প্রতি মানুষের শোষণ বন্ধ করে একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। কৃষকের স্বপ্ন ছিল শ্রম ও ফসলের ন্যায্য মূল্য, শ্রমিকের স্বপ্ন ছিল ন্যায্য মজুরী। মধ্যবিত্তের স্বপ্ন ছিল নিজেদের বিকাশের। আমার ব্যক্তিগত কোন আলাদা স্বপ্ন ছিল না, কোটি কোটি মানুষের মধ্যেই একাত্ম ছিল।
    উৎসঃ সাদেক হোসেন খোকা; আহমেদ মূসার সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎকার: ফেব্রুয়ারী ১৯৯৬।
    ১৪. আমরা মনে করেছি, দেশ সুন্দরভাবে চলবে। আমাদের উন্নতি হবে। গোলামী থেকে মুক্তি পাবার জন্য আমরা অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটিয়েছি। সেই দুঃখ কষ্ট থেকে রেহাই পাবার জন্য আমরা স্বাধীনতা চেয়েছি।
    দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে ঘিরে আমার যে স্বপ্ন ছিল তা হলো দেশ স্বাধীন হলে আমার অবস্থার উন্নতি হবে। সুখে শান্তিতে বাস করতে পারবো। আমার ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে পারবো। আমার আরো স্বপ্ন ছিল সারের দাম, ঔষুধের দাম, বীজের দাম, তেলের দাম, কাগজের দাম, জিনিসের দাম কমবে এবং নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যের দাম কমবে যাতে আমি সুন্দরভাবে সংসার চালাতে পারবো।
    উৎসঃ জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া
    গ্রাম: বরইয়া, ডাক: জোয়ার কাছাড়, থানা: ফেনী, জেলা: ফেনী।
    গরীব কৃষক। বয়স ১৯৭১ সালে: ২২ বছর।
    আহমেদ মূসা সম্পাদিত জনগণের মুক্তিযুদ্ধ চেতনার স্বরূপ সন্ধান, পৃষ্ঠা - ১৪৬
    ১৫. মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কোন বায়বীয় ব্যাপার নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে হচ্ছে বাঙালী জাতি দীর্ঘদিন যাবৎ তার রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার জন্য একটি সমাজ পরিকল্পনার লড়াই করেছে। সেই সমাজটি হচ্ছে শোষণমুক্ত অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সমাজ। তদানীন্তন পাকিস্তানে একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে, একটি বহুধর্মভিত্তিক সমাজ, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সমাজের জন্যই ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ’৬২-ও ছাত্র আন্দোলন, ৬ দফা ও ১১ দফার আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন এবং ’৭১-র মুক্তিযুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। এই আশার কথা ৬ দফা, ১১ দফাতে পরিস্কারভাবে লেখা ছিল। এরই রূপ দেয়া হয়েছিল ’৭২-এর সংবিধানের ৪টি স্তম্ভের মধ্যে। এটিই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এটি চিরকালীন, শাশ্বত।
    উৎসঃ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত; দৈনিক জনকণ্ঠ, ২৪ মার্চ ১৯৯৩।
    ১৬. পাকিস্তান আমলে আমি সামরিক বাহিনীতে যোগদান করি। সেখানে দেখি আমাদের প্রতি পাকিস্তানীদের বৈষম্যমূলক আচরণ। চাকুরি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামরিক বাহিনী এবং সরকারের বিভিন্ন উচ্চপদে পাঞ্জাবীদের প্রাধান্য। আমাদের যোগ্যতা থাকলেও এসব উচ্চ পদে নিয়োগ দেয়া হতো না। তাই এসব অন্যায়, অত্যাচার এবং শোষণ থেকে মুক্তি পাবার জন্য পাকিস্তানীদের কাছ থেকে আলাদা হতে চেয়েছি, মুক্তি পাবার উগ্র বাসনায় আমাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে প্রেরণা যুগিয়েছে। আমার ব্যক্তিগত কোনো স্বপ্ন ছিল না। দেশের মানুষ ভালোভাবে থাকবে, শান্তিতে থাকবে, মানুষ তার মৌলিক অধিকার ভোগ করতে পারবে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে, এটাই ছিল সামগ্রিক স্বপ্ন।
    উৎসঃ সুবেদার মোঃ হারুন অর রশিদ
    গ্রাম: বিষ্ণু রামপুর, থানা: বাঞ্ছারামপুর, জেলা: ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
    সৈনিক-মুক্তিযোদ্ধা। বয়স ১৯৭১ সালে: ৩২ বছর।
    আহমেদ মূসা সম্পাদিত জনগণের মুক্তিযুদ্ধ চেতনার স্বরূপ সন্ধান, পৃষ্ঠা - ১৪৯
    ১৭. মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে একজন সাধারণ সচেতন নাগরিক হিসাবে আমি মনে করি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অর্থ স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষা, গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বচার প্রতিষ্ঠা। মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ্য এটাই ছিল। বাংলাদেশের জনগণ ১৯৪৮ সাল থেকেই উপলব্ধি করতে থাকে যে, পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী আমাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে অক্টোপাশের মতো ধীরে ধীরে গ্রাস করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তারই ফলে ১৯৪৮ সালে সূচিত হয় প্রথম রাষ্ট্র ভাষার দাবিতে আন্দোলন। যা পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি গৌরবোজ্জ্বল বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে মাতৃভাষা বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে। পরবর্তীকালে অগ্রসর চিন্তার স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশবাসীর রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিযে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে।
    কিন্তু আজ মুক্তিযুদ্ধ দলীয়করণ করার অপচেষ্টা পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান, মরহুম জিয়াউর রহমান ও অন্যান্য নেতার যাঁর যতটুকু অবদান তাঁর যথাযোগ্য স্বীকৃতি দেয়া উচিত। একথা অনস্বীকার্য যে, দেশের কিছু সংখ্যক লোক ছাড়া আপামর জনসাধারণ সক্রিয় ও আন্তরিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে ভূমিকা রেখেছিল। কাজেই মুক্তিযুদ্ধের এই সাফল্য কোন ব্যক্তি বা দলের একক সাফল্য হিসাবে পরিগণিত হতে পারে না।
    উৎসঃ বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরী; দৈনিক জনকণ্ঠ, ২৪ মার্চ ১৯৯৪।
    ১৮. ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে চেতনা ছিল পূর্ণ স্বাধীনতা, যার আওয়তায় সমস্ত বৈষম্য সাম্প্রদায়িকতার অবসান এবং সামাজিক ন্যায়বিচার, সম্প্রদায়ভিত্তিক বৈষম্যের অবসান, মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। সমস্ত ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে বাঙালী পরিচয়ে পরিচিত হওয়া। কাউকে যেন হেয় প্রাতিপন্ন না হতে হয়। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সমস্ত উপজাতীয় সম্প্রদায়ের রাষ্ট্রীয় অধিকারসমূহে সমানভাবে অধিকারী হওয়া। এটাই ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
    ‘৭১-এর সেই উত্তাল দিনে নিজের ব্যক্তিগত স্বপ্ন আর সমষ্টিগত স্বপ্ন সব একাকার হয়ে মিশে গিয়েছিল বিজয়ের সংগ্রামে। জুলুমবাজ, ষড়যন্ত্রারী পাকিস্তানীদের কবল থেকে মুক্ত হয়ে মানুষ হিসাবে মাথা তুলে দাঁড়ানোর স্বপ্নই আমরা দেখেছিলাম।
    উৎসঃ মনোজ কান্তি দত্ত
    গ্রাম: গান্দিয়ান্ডর, ডাক: বৌতলী, জেলা: গোপালগঞ্জ।
    উর্ধ্বতন নকশাবিদ, বিসিক। বয়স ১৯৭১ সালে: ১৭ বছর।
    আহমেদ মূসা সম্পাদিত জনগণের মুক্তিযুদ্ধ চেতনার স্বরূপ সন্ধান, পৃষ্ঠা - ১৫০
    ১৯. পাকিস্তানী আমলে ভাষা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পরই পাকিস্তানের নাগরিক হিসাবে আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য আমরা তৎকালীন সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রাম করেছি। সুতরাং এই গণতান্ত্রিক চেতনা মুক্তিযুদ্ধের তৃতীয় চেতনা। পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু অধিবাসী হলেও বাঙালীরা অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হয়েছিল যার থেকে ৬ দফা দাবির উদ্ভব। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের চতুর্থ চেতনা বলতে আমি বাংলাদেশের সর্বশ্রেণীর মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির চেতনাকে বুঝি।
    উৎসঃ রফিকুল ইসলাম; দৈনিক জনকণ্ঠ, ২৪ মার্চ ১৯৯৩।
    ২০. আমরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র পাবো। আমাদের আর পশ্চিম পাকিস্তানীদের তাঁবেদার হয়ে থাকতে হবে না। তাদের শোষণ বঞ্চনার শিকার হতে হবে না। নিজের ভাগ্য নিজেরা গড়বো। বিশ্ব দরবারে একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসাবে মাথা তুলে দাঁড়াবো। পূর্ণ গণতন্ত্র পাবো, আমাদের বাক-স্বাধীনতা থাকবে। অভাবহীন, ক্ষুধাহীন ধন-ধান্যে-পূর্ণ ভবিষ্যতের সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলার চিত্রটি মানসকক্ষে দেখতে পেতাম।
    আসলে ব্যক্তিগত স্বপ্ন তেমন ছিল না। স্বপ্ন দেখতাম সবাইকে নিয়ে, সামগ্রিকভাবে সবাইর মুখে হাসি ফুটবে, সবাইর অন্ন, ধর্ম, কর্ম ও চিকিৎসা সমস্যা মিটবে। আমাদের আর পরমুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না। সবাই সুখী হলে আমিও সুখী হবো। সকলের সুখই আমার সুখ। সেই সকলের সুখের জন্য ব্যক্তিগতভাবে আমার যা করণীয়, আমার যা অবদান রাখা দরকার, আমার যেটুকু ত্যাগের প্রয়োজন আমি তা করবো।
    উৎসঃ শেখ নূরুল ইসলাম
    দৈনিক দিনকাল, ২২ তোপখানা
    সাংবাদিক। বয়স ১৯৭১ সালে: ২২ বছর।
    আহমেদ মূসা সম্পাদিত জনগণের মুক্তিযুদ্ধ চেতনার স্বরূপ সন্ধান, পৃষ্ঠা - ১৭০
    ২১. ভদ্রলোকরা শ্রেণীগতভাবে যখন সমাজে এই মিথ্যাটা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে যে তাদের শ্রেণীর অংশগ্রহণটাই মুক্তিযুদ্ধের আসল কথা, তাদের চেতনাটাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তখন সেই বিকৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো ছাড়া আর উপায় থাকে না। এই বিকৃতি আমরা ভাঙতে চাই। সত্যিকার অর্থে যুদ্ধ করেছে তারামন এবং তাদের শ্রেণী। গরিব, নিঃস্ব বাংলাদেশের খেটে খাওয়া মানুষ। শিশু কিশোর। তাঁরা আমাদের সিনেমায়, ছবিতে, সাহিত্যে, উপন্যাসে, কাব্যে কি আসে? আসে না।
    উৎসঃ ফরহাদ মাযহার; মাসিক চিন্তা, বছর ৫, সংখ্যা ৮, ১৬ পৌষ, ১৪০২, ৩০ ডিসেম্বর, ১৯৯৫।
    ২২. ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় শেখ মুজিব বলেছিলেন, চাল, ডাল, তেল, কাগজসহ নিত্য-ব্যবহার্য জিনিসের দাম কমিয়ে দেবেন। পশ্চিমারা আমাদের শাসন করতো। আমরা স্বায়ত্তশাসন চাই। তিনি আরো বলেছিলেন, আমাদের দেশে কাগজ তৈরি হয়। কিন্তু করাচী নিয়ে যায় সীল মারার জন্যে। ফলে কাগজের দাম বেড়ে যায়। আমরা তাঁর এসব কথায বিশ্বাস করে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়েছিলাম।
    আমি ভেবেছিলাম, দেশ স্বাধীন হলে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখাতে পারবো। সুখে শান্তিতে দিন কাটাবো। জিনিসপত্রের দাম কমে যাবে। আমাদের অবস্থার আরো উন্নতি হবে। মোট কথা, আমাদের কষ্ট দূর হবে।
    উৎসঃ সোনা মিয়া
    গ্রাম: আমিরাবাদ, সদরপুর, জেলা: ফরিদপুর।
    দারোয়ান। বয়স ১৯৭১ সালে: ৩৬ বছর।
    আহমেদ মূসা সম্পাদিত জনগণের মুক্তিযুদ্ধ চেতনার স্বরূপ সন্ধান, পৃষ্ঠা - ১৫২
    ২৩. কালের বিচারে পাকিস্তানের ধর্মীয় রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদ অবাস্তব বলে প্রমাণিত হলো। এদেশে পুনর্জন্ম লাভ করলো সমাজ, সংস্কৃতি, ভুগোল, নৃতত্ত্বভিত্তিক জাতীয়তাবাদের শাশ্বত ধারণা যার নাম বাঙালী জাতীয়তাবাদ। বাংলাদেশের সকল নাগরিকের সমান অধিকার। রাষ্ট্রে সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু বলে কিছু নেই। তাই সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে অধিকার নিয়ন্ত্রিত হবার কথা নয়। রাষ্ট্রকে অসাম্প্রদায়িক হতে হবে। হতে হবে ধর্মনিরপেক্ষ - এটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
    উৎসঃ সৈয়দ হাসান ইমাম; দৈনিক জনকণ্ঠ, ২৪ মার্চ ১৯৯৩।
    ২৪. পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিলো চরম পর্যায়ের। চাকরি এবং ব্যবসা-বাণিজ্য সর্বক্ষেত্রেই একই অবস্থা বিরাজ করছিলো। নির্বাচনে বাঙালীরা বেশি আসন পেলেও পাকিস্তানীরা ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে ষড়যন্ত্র শুরু করে। তাই বাঙালীদের স্বায়ত্তশাসনের দাবি স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ নেয়।
    সুখ শান্তিতে থাকবো এবং সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর হবে - সর্বোপরি, মানুষ হিসেবে সবাই বেঁচে থাকার অধিকার লাভ করবে। এটাই ছিলো আমার স্বপ্ন।
    উৎসঃ সিদ্দিকুর রহমান ভূঁইয়া, মুক্তিযোদ্ধা
    ছাগল নাইয়া, জেলা: ফেনী।
    সুকানী (রাজহংস স্টিমারের)। বয়স ১৯৭১ সালে: ৩৫ বছর।
    আহমেদ মূসা সম্পাদিত জনগণের মুক্তিযুদ্ধ চেতনার স্বরূপ সন্ধান, পৃষ্ঠা - ১৫২-১৫৩
    ২৫. বাঙালী সংস্কৃতি ও বাঙালী জাতীয়তাবাদী চেতনা এবার সুষ্ঠুভাবে বিকশিত হবে, দেশ থেকে ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতা নির্বাসিত হবে, ধর্ম হবে নাগরিকের একান্ত ব্যক্তিগত আচরণের বিষয, রাষ্ট্র তার মধ্যে কোনোভাবেই হস্তক্ষেপ করবে না, ধর্ম নিয়ে কাউকে রাজনীতি করতে দেয়া হবে না আর স্বৈরাচারী শাসনের স্টিমরোলার নয়, অবাদ নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে দায়িত্ব, আস্থা ও ক্ষমতাপ্রাপ্ত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশ শাসিত হবে, সরকারি কর্মচারীরা প্রকৃত অর্থেই জনগণের সেবক হবেন, প্রভু নন, দেশে ধনী দরিদ্রের শ্রেণী বৈষম্য কমিয়ে আনতে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল।
    উৎসঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল; স্বাধীন বাংলাদেশের বিশ বছর: হিসাব কি মেলে? মুহম্মদ জাফর ইকবাল সম্পাদিত; পুনর্মুদ্রণ: জনগণের মুক্তিযুদ্ধ চেতনার স্বরূপ সন্ধান
    ২৬. পাকিস্তানীরা মনে করতো, বাঙালীরা অতি সাধারণ, বাঙাল। মনন-মেধা কিছুই আমাদের নেই। তাদের এ হীনমানসিকতা বাঙ্গালীদের মনে ক্ষোভের সঞ্চার করে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তারা বৈষম্যমূলক আচরণ করতো। পাকিস্তানীদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন তথা ভাষার ওপর আঘাত এবং দ্রব্যমূল্যের বৈষম্যমূলক নির্ধারণ বাঙালীদের স্বাধীনতা লাভে অভিলাষী কওে তোলে।
    পাকিস্তানীদের হীনমানসিকতা এবং শোষণ থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছি। সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়াই ছিলো স্বাধীনতা যুদ্ধকে ঘিরে আমার ব্যক্তিগত স্বপ্ন।
    উৎসঃ আনিস উদ্দিন আহমেদ, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারি।
    ২৭/৮, বনগ্রাম রোড, ঢাকা।
    বয়স ১৯৭১ সালে: ৪২ বছর।
    আহমেদ মূসা সম্পাদিত জনগণের মুক্তিযুদ্ধ চেতনার স্বরূপ সন্ধান, পৃষ্ঠা - ১৫৫
    ২৭. বাংলার দুর্ভাগ্য আইনানুগ উত্তরাধিকরী বদলে সর্বস্তরের নেতৃত্ব এসেছে তাদেরই হাতে যারা প্রাক-বিপ্লবী যুগে ছিল ক্ষমতার উৎস। রাষ্ট্র, প্রশাসনযন্ত্র সেই পুরানো ব্যক্তিরাই চালান। বাণিজ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও তারাই। যে সামরিক অফিসার পাকিস্তানী সৈন্যদের হাতে, তিনি এখন মুক্তিযোদ্ধাদের নামে হুলিয়া বের করতে ব্যস্ত। যে আমলারা রাত দিন খেটে তৈরি করেছে রাজাকার বাহিনী, তারা মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরি দিয়ে দয়া প্রদর্শনের অধিকারী। যে শিক্ষক দেশের ডাকে সাড়া দিতে পারেনি, তিনিই আজ তরুণদের শিক্ষা দেয়ার দায়িত্ব পেয়েছেন। যে ব্যবসাযী স্বাধীনতা যুদ্ধকালে চুটিয়ে ব্যবসা করেছেন তিনি আজো মনে করেন জনগণকে ঠকানো তাদের জন্মগত অধিকার। পরিকল্পনা বিভাগের যে কর্মীকে শোষণের পরিকল্পনা তৈরি করা শেখানো হয়েছে, বছরের পর বছর ধরে তিনিই এন সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পরিকল্পনা তৈরি করেন। যুদ্ধচলাকালে যারা পাকিস্তানীদের হয়ে প্রচারণায মত্ত ছিলেন ১৬ ডিসেম্বরের পর তারাই ভোল পাল্টে সংস্কৃতির মধ্যমণি হয়েছেন।
    উৎসঃ আবু তাহের বীর উত্তম; মুক্তিযোদ্ধারা জয়ী হবে: স্বাধীন বাংলাদেশের বিশ বছর হিসাব কি মেলে? মুহম্মদ জাফর ইকবাল সম্পাদিত; পুনর্মুদ্রণ: জনগণের মুক্তিযুদ্ধ চেতনার স্বরূপ সন্ধান, পৃষ্ঠা ১১৮-১১৯
    ২৮. আমার মালিক ছিলো পাঞ্জাবী। কারণে-অকারণে বাঙাল বলে গালিগালাজ করতো। এক কথায় শেয়াল-কুকুরের মতো ব্যবহার করতো আমার সঙ্গে। মানুষ বলে মনে করতো না। মনে মনে ভাবতাম, কবে পশ্চিমাদের রাজত্বের অবসান ঘটবে আমাদের দেশের ওপর থেকে? কবে মুক্তি পাবো ওদের শোষণ থেকে? ভাসানী এবং শেখ মুজিব আমাদের মুক্তির স্বপ্ন দেখান। সেই স্বপ্নই ছিলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
    মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার এবং সুখে শান্তিতে বসবাস করার অধিকারটুকু অর্জনই ছিলো আমার ব্যক্তিগত স্বপ্ন।
    উৎসঃ মোঃ চান মিয়া
    ১১৯, বনগ্রাম রোড, ঢাকা।
    বাস ড্রাইভার। বয়স ১৯৭১ সালে: ২৫ বছর।
    আহমেদ মূসা সম্পাদিত জনগণের মুক্তিযুদ্ধ চেতনার স্বরূপ সন্ধান, পৃষ্ঠা - ১৫৬
    ২৯. ওই যে চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, তার সংজ্ঞাটি কি? বিতর্কে না গিয়ে বলা যায়, চেতনাটি সংজ্ঞায়িত হয়েছিল প্রথম সংবিধানের চার মূলনীতিতে, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রে। ওই মূলনীতিগুলো থেকে আমাদেরকে সরিয়ে দেয়াই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতানকে ভুলুণ্ঠিত করা। মুক্তিযুদ্ধের সেই মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান এবং বেতারে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে সমগ্র জাতিকে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধকরণের সেই সাহসী পুরুষ জিয়াউর রহমান উভয়েই নিহত হয়েছেন। পাঞ্জাবীর হাতে নয়, বাঙালীর হাতে। অবিশ্বাস্য ঘটনা, কিন্তু সত্য তো অবশ্যই। ইতিহাস এই ঘটনার ব্যাখ্যা কিভাবে করবে। ব্যাখ্যা একটাই, সেটা হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাষ্ট্রীয় পশ্চাদপসরণকে নিশ্চিত করা।
    উৎসঃ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী; স্বাধীন বাংলাদেশের বিশ বছর: হিসাব কি মেলে? মুহম্মদ জাফর ইকবাল সম্পাদিত; পুনর্মুদ্রণ: জনগণের মুক্তিযুদ্ধ চেতনার স্বরূপ সন্ধান, পৃষ্ঠা - ১১৯
    ৩০. পরাধীন ছিলাম বলে স্বাধীনতা চেয়েছি। নিজেদের দেশ নিজেরা শাসন করবো, এটাই ছিলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। নিজের ভাগ্য নিজেই গড়বো, এটাই ছিলে আমার ব্যক্তিগত স্বপ্ন।
    উৎসঃ আবদুল হাকিম
    গ্রাম: খাসচর, সদরপুর, জেলা: ফরিদপুর।
    সাপুড়ে। বয়স ১৯৭১ সালে: ২৯ বছর।
    আহমেদ মূসা সম্পাদিত জনগণের মুক্তিযুদ্ধ চেতনার স্বরূপ সন্ধান, পৃষ্ঠা - ১৫৮
    ৩১. স্বীয় শ্রেণী স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করলেও আওয়ামী লীগ জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন লাভ করেছিল। তবে এই সমর্থন ছিল শতাব্দী ধরে যে সাম্রাজ্যবাদী ও সামন্তবাদী শোষণের অক্টোপাস জনগণেকে আষ্ট্রে পৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে সেই অক্টোপাসের বাঁধন থেকে মুক্তির জন্য আকাংক্ষা থেকে উৎসারিত। এই আকাংক্ষাকে ব্যবহার করে এদেশের বিকাশোন্মুখ মুৎসুদ্দী পুঁজি ও সামন্তাবশেষের প্রতিনিধি শেখ মুজিব ও তার আওয়ামী লীগ এবং প্রথম দিকে ‘পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন অর্জনের মধ্যে’ ও পরের দিকে পশ্চিম পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তির মধ্যে এদেশের জনগণের সার্বিক মুক্তি নিহিত বলে বক্তব্য তুলে ধরে জনমতকে তার প্রতি সন্নিবেশিত করে।
    উৎসঃ মেসবাহ কামাল; শ্রেণী দৃষ্টিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, পৃষ্ঠা ৪৩-৪৫
    ৩২. ১৯৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য ও চেতনায় গণমানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে, সমগ্র বাঙালী জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার অদম্য আকাঙ্ক্ষায় এবং মুক্তিযুদ্ধে সফলতার মধ্য দিয়ে বঞ্চিত মানুষের ন্যায্য অধিকার সংরক্ষণের চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছিল।
    স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী ছিলাম। তখনার প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধকালীন পূর্বাবস্থা এবং পরবর্তী অবস্থায় সমগ্র জাতির মধ্যে যুদ্ধের বিভীষিকা মোকাবেলা করলেও দেশপ্রেমের অনুভূতি প্রবল থেকে প্রবলতর ছিল। যে দেশাত্মবোধের ও প্রেরণার লক্ষ্য ছিল মানুষে মানুষে মমত্ববোধ, সম্পদের সুষ্ঠু বন্টন, খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা ও বাসস্থানের নিশ্চয়তাসহ আইনের শাসন এবং সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় দেশকে সঠিক ও সুন্দরের পথে এগিয়ে নিয়ে মানুষের কল্যাণ করা।
    উৎসঃ মালেকা পারভীন
    ১৯, পশ্চিম মালিবাগ, ঢাকা।
    আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট। বয়স ১৯৭১ সালে: ২১ বছর।
    আহমেদ মূসা সম্পাদিত জনগণের মুক্তিযুদ্ধ চেতনার স্বরূপ সন্ধান, পৃষ্ঠা - ১৫৯-১৬০
    ৩৩. ... কুন্ডেশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী কিশোরী খালেদা হানাদার বাহিনীর তত্ত্বাবানে অনুষ্ঠিত মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা বর্জন করেছিল। গৃহবধু জয়নাব তখন স্বাধীন বাংলা বেতারের নির্দেশকে শিরোধার্য করে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক অচল ঘোষিত (পাঁচশত) টাকার নোট ব্যাংকে জমা করেনি। বিধবা রায়লা ঘরে বসে থাকা তার কলেজগামী সন্তানকে এই বলে মুক্তিযুদ্ধে ঠেলে দিয়েছিলেন যে “বাবা, মিলিটারীরা আমার সামনে থেকে তোমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে গুলি করবে, তা আমি সহ্য করতে পারব না। তার চাইতে দেশের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে শহীদ হওয়া শ্রেয়”। কাপ্তাই হাইস্কুলের হাফেজ মওলানা আবদুল কাদের চৌধুরী তার বিশ্ববিদ্যালয়গামী তিন সন্তানকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ব্যাপারে এই বলে উৎসাহ জুগিয়েছিলেন যে, আমার যদি আজ দু’টি হাত ভাল থাকতো, তাহলে এই বৃদ্ধ বয়সে আমিও তোমাদের সাথে অস্ত্র নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতাম।
    উৎসঃ আবদুন নূর; মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, পৃষ্ঠা - ৭
    ৩৪. স্বপ্ন ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ গড়া, যে দেশে সবাই শান্তিতে বসবাস করবে। আমরা আমাদের দেশকে মনের মতো করে গড়বো। তখন আমাদের পরিচয় হবে আমরা বাংলাদেশী।
    আমি আশা করেছিলাম আমরা এমন একটি দেশ পাবো যেখানে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিপক্ষে যারা ছিলেন তাদের এটা বিচার হবে। যাতে যেসব মুক্তিযোদ্ধা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন তাদের আত্মা শান্তি পায়।
    উৎসঃ এম. এ. মালেক
    ২০, ইস্কাটন গার্ডেন রোড, ঢাকা।
    ডাক্তার। বয়স ১৯৭১ সালে: ১৯ বছর।
    আহমেদ মূসা সম্পাদিত জনগণের মুক্তিযুদ্ধ চেতনার স্বরূপ সন্ধান, পৃষ্ঠা - ১৬০-১৬১
    ৩৫. আমার নানা সংগঠন করতেন। মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্র। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাটা আসলে কি তা কখনো জিজ্ঞাসা করিনি তাকে। ধরেই নিয়েছিলাম, যে কোনো স্বাধীনতা, স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রামে যে অপরিহার্য চেতনাগুলো থাকে তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমতা প্রতিষ্ঠা এসবই। তার সঙ্গে যুক্ত আমাদের জাতিগত কিছু অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম যা মূলত সংস্কৃতি ও ভাষাকেন্দ্রিক।
    নানাকে কখনো এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন না করেই তার দেওয়া একটা ব্যাজ পরতাম। তাতে লেখা ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা - আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
    উৎসঃ জায়েদ আলমের খান; সাপ্তাহিক ২০০০ ডিসেম্বর, ২০০১
    ৩৬. দেশ স্বাধীন হবে। দেশের মানুষ সুখে শান্তিতে থাকবে। সর্বোপরি মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে, আমার মতে, এটাই ছিলো একাত্তরের স্বাধীনতার মূল চেতনা। আমি বিহারীদের সঙ্গে চুল কাটার কাজ করতাম, শালার মাউরারা উর্দুতে আমাকে গালিগালাজ করতো, কিছুই বুঝতাম না। কাউকে জিজ্ঞেস করে বুঝতে পারলে মাথা গরম হয়ে যেতো। কি যে করি? শুধু পেটের জন্য কিছুই করতে পারতাম না। স্বাধীনতা লাভ করাতে তাদের গালিগালাজ আর শুনতে হয় না।
    আমরা খেয়ে-পরে ভালো মতো চলতে পারবো এটাই ছিলো স্বাধীনতার যুদ্ধকে ঘিরে স্বপ্ন।
    উৎসঃ হারাধন চন্দ্র শর্মা
    গ্রাম: মজলিশপুর, থানা ও জেলা: ফেনী
    ক্ষৌরকার। বয়স ১৯৭১ সালে: ২২ বছর।
    আহমেদ মূসা সম্পাদিত জনগণের মুক্তিযুদ্ধ চেতনার স্বরূপ সন্ধান, পৃষ্ঠা - ১৬২-১৬৩
    ৩৭. মুদি দোকানদার, ক্ষেতমজুর থেকে শুরু করে বড়লোক বাবার গাড়ি হাঁকানো জেলেরাও অংশ নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধে। যুদ্ধ শেষে বড়লোক ছেলেটি তো ফিরে গেছে তার ধানমন্ডির বাড়িতে। সে হিসেবে ক্ষেতমজুরকে ফিরে যেতে হয় তার ক্ষেতে। বাকি জীবন কাটাতে হয় চাষবাস করে। তার প্রতি দেশের কোনো দায় নেই? তাকে দেবার মত কিছু নেই? একজন শহীদের পরিবারের কাছে দেশের দায়বদ্ধতাই বা কতটুকু?
    উৎসঃ তানিম আহমেদ; সাপ্তাহিক ২০০০ ডিসেম্বর, ২০০১
    ৩৮. পাকিস্তান আমলে এ দেশের মানুষেরা কোন চাকরি পেতে না। সবখানেই পশ্চিম পাকস্তানীদের চাকরি হতো। সাধারণ নির্বাচনের সময় শুনেছি পূর্ব পাকিস্তানে প্রস্তুতকৃত কাগজ পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যেতো সীল মারার জন্য। পরে আবার আসতো এ দেশে। ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে পূর্ব পাকিস্তানে কাগজের দাম বেশি পড়তো। এটা আমার মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। তাই মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করি। মূলত দেশ সেবার মহৎ উদ্দেশ্যই ছিলো আমার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। ভালোভাবে চলতে পারবো। সুখে-শান্তিতে বসবাস করবো। দেশে কোন ঘুষখোর থাকবে না।
    স্বপ্ন আমার পূরণ হয়নি।
    উৎসঃ মোঃ আতাউল হক বেপারী, মুক্তিযোদ্ধা।
    গ্রাম: সংসাবাদ, থানা: নবাবগঞ্জ, ঢাকা।
    ছৈয়াল। বয়স ১৯৭১ সালে: ২২ বছর।
    আহমেদ মূসা সম্পাদিত জনগণের মুক্তিযুদ্ধ চেতনার স্বরূপ সন্ধান, পৃষ্ঠা - ১৬৪-১৬৫
    ৩৯. মাঠগুলি পুনঃ ফসলে ফসলে পরিবে রঙিন বেশ
    লক্ষ্মীর ঝাঁপি গড়ায়ে ছড়ায়ে ভরিবে সকল বেশ
    মায়ের ছেলেরা হবে নির্ভর, মুখ হাসি ভরা ঘরে
    দস্যুবিহীন এদেশ আবার শোভিত সুষমা ভরে।
    উৎসঃ জসীম উদ্দীন; মুক্তিযোদ্ধা, ১৬ জুলাই-১৯৭১; আবুল হাসনাত সম্পাদিত ‘মুক্তিযুদ্ধেও কবিতা’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত।
    ৪০. আমার মতে স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনাগুলো হলো, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে দ্রব্যমূল্যের পার্থক্য। বাঙালীদের উত্থাপিত দাবি-দাওয়া না মানা। সর্বক্ষেত্রে পাকিস্তানীদের অগ্রাধিকার দেয়া। বাঙালীদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করা।
    আমার কোন ব্যক্তিগত স্বপ্ন ছিলো না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ঘিরে আমাদের যে স্বপ্ন ছিল তা পূরণ হয়নি।
    উৎসঃ মোঃ আবুল হোসেন খান, মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যকারী।
    গ্রাম: জামালপুর, রামগঞ্জ; জেলা: লক্ষ্মীপুর।
    পত্রিকার হকার। বয়স ১৯৭১ সালে: ২৩ বছর।
    আহমেদ মূসা সম্পাদিত জনগণের মুক্তিযুদ্ধ চেতনার স্বরূপ সন্ধান, পৃষ্ঠা - ১৬৫
    ৪১. খুঁজে নেব মৃগনাভি/বিলিয়ে দেব সবার মাঝে
    যেন তেন একটি নতুন জামা/আটা আধসের
    সেমাই এক পোয়া/এক ছটাক বাদাম কিসমিস
    তখন প্রশ্ন থাকে/এক ফোঁপা আতর
    কোনো রকম একখানি গামছা/খুদ এক পোয়া
    আধ ছটাক গুড়/গরিবের শিরনি
    আর বড় জোর এক ছিলিম তামাক।
    উৎসঃ শহীদুল্লাহ কায়সার; আজকের প্রশ্ন; আবুল হাসনাত সম্পাদিত ‘মুক্তিযুদ্ধেও কবিতা’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত।
    ৪২. একাত্তর সালে পাক হানাদাররা মা বোনদের ইজ্জত লুটে নিয়েছিলো শুনছিলাম। একদিন আমার চোখের সামনে থেকে আমার এক চাচাতো বোনকে রাজাকার এবং পাকহানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। তারা আমার বোনের ওপর এমন পাশবিক নির্যাতন চালায় যে, তাকে চিরদিনের মতো পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়। এই পশুদের বাংলার মাটি থেকে বিতাড়িত করার জন্য আমি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেই।
    সব মানুষ সমান অধিকার পাবে। ন্যায়বিচার পাবে। সুখে শান্তিতে বসবাস করবে। এটাই ছিলো আমার ব্যক্তিগত স্বপ্ন।
    উৎসঃ মোঃ হায়দার আলী, মুক্তিযোদ্ধা।
    গ্রাম: উত্তর গঙ্গারামপুর, মুকসেদপুর, গোপালগঞ্জ।
    তালামিস্ত্রি। বয়স ১৯৭১ সালে: ১৮ বছর।
    আহমেদ মূসা সম্পাদিত জনগণের মুক্তিযুদ্ধ চেতনার স্বরূপ সন্ধান, পৃষ্ঠা - ১৬৬-১৬৭
    ৪৩. নিজেকে বাঁচতে হলে পরে নাও হরিৎ পোশাক
    সবুজ শাড়িটি পর ম্যাচ করে, প্রজাপতিরা যেমন
    জন্ম-জন্মান্তর ধরে হয়ে থাকে পাতার মতন
    প্রাণের ওপরে আজ লতাগুল্ম পত্রগুচ্ছ ধরে
    তোমাকে বাঁচতে হবে হতভস্ব সন্তুতি তোমার
    উৎসঃ আল মাহমুদ; ক্যামোফ্লেজ; আবুল হাসনাত সম্পাদিত ‘মুক্তিযুদ্ধেও কবিতা’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত।
    ৪৪. একটি শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা, সমৃদ্ধ স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন ছিলো মূলচেতনা। পাকিস্তানী শোষক, শাসকচক্রের যাঁতাকলে পড়ে এদেশের মানুষ চেয়েছিল স্বাধীনভাবে নিজস্ব পরিচয়ে বাঁচতে। আর সেই চেতনা থেকেই মুক্তিযুদ্ধের শুরু। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এদেশের মানুষকে একটি সূত্রে গ্রন্থিত করেছে। একটি নতুন জাতি হিসাবে বিশেষ পরিচিত এনে দিয়েছে। স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আপোসহীনতা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আরেকটি উপাদান। ভেবেছিলাম আমরা যখন বড়ো হবো তখন দেখবো একটি মর্যাদাশীল জাতির আমি একটি অংশ।
    উৎসঃ মহিউদ্দিন খান মোহন
    গ্রাম: মাকুর গাঁও, পো: শ্রীনগর, জেলা: মুন্সীগঞ্জ।
    লেখক-সাংবাদিক। বয়স ১৯৭১ সালে: ১৬ বছর।
    আহমেদ মূসা সম্পাদিত জনগণের মুক্তিযুদ্ধ চেতনার স্বরূপ সন্ধান, পৃষ্ঠা - ১৬৯-১৭০
    ৪৫. বিশাল মিউরাল বানাবার জন্য যখন টাওন পদ্মামেঘনা কর্ণফুলী
    তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ ক্লাসিক ক্যানভাস হয়ে দুরুদুরু
    জাগছিল
    শত্রুরা জেনেছিল ঠিকই
    কিন্তু।
    কৈশোরে ন্যাংটো আমি ঝাঁপিয়ে পড়ে ব্রহ্মপুত্রের ভিতরে ঝিনুক
    খুঁজতে খুঁজতে তোমাকে চেয়েছি।
    উৎসঃ আলাউদ্দিন আল আজাদ; স্বাধীনতা ওগো স্বাধীনতা; আবুল হাসনাত সম্পাদিত ‘মুক্তিযুদ্ধেও কবিতা’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত।
    ৪৬. ১৯৭০ সালের নির্বাচনে শেখ সাহেবকে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়েছিলাম দেশের উন্নতির জন্য। তারপর দেশ স্বাধীন হলো । ভোট দিয়েছিলাম ভাত কাপড় পাবো বলে এবং ছেলেমেয়েদের নিয়ে শান্তিতে বসবাস করতে পারবো বলে।
    শেখ সাহেব মরে গেলো বলে কিছুই পাইনি। আল্লাহ এখন তাঁর এক মেয়েকে দিয়েছে আমাদের দেখাশোনা করার জন্য। আল্লাহ তাকে হেফাজত করুক, এই দোয়াই করি।
    উৎসঃ ফরজ আলী
    গ্রাম: কাটাখালী, দশমিনা, পটুয়াখালী।
    ভিক্ষুক। বয়স ১৯৭১ সালে: ৩৫ বছর।
    আহমেদ মূসা সম্পাদিত জনগণের মুক্তিযুদ্ধ চেতনার স্বরূপ সন্ধান, পৃষ্ঠা - ১৭১
    ৪৭. ট্রিগারে আঙ্গুল রেখে পুনর্বার বুঝে নিতে চাই
    অনিায়কের কণ্ঠ উচ্চরিত গাড় শব্দাবলি
    শপথ প্যারেডে: তোমার মনে রাখা প্রয়োজন
    এই যুদ্ধ ন্যায় যুদ্ধ …
    উৎসঃ রফিক আজাদ; সৌন্দর্য-সৈনিকের প্রকৃত প্যারেড; আবুল হাসনাত সম্পাদিত ‘মুক্তিযুদ্ধেও কবিতা’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত।
    ৪৮. পাকিস্তানের গোলামী থেকে মুক্তির জন্য স্বাধীনতা চেয়েছি। স্বাধীন হলে নিজেদের মতো চলতে পারবো এবং আমাদের দেশের উন্নতি হবে। এটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
    তখন আমি বিএ ক্লাশের ছাত্র। পড়াশোনা শেষে একটা চাকরি পাওয়াই ছিলো আমার ব্যক্তিগত স্বপ্ন।
    উৎসঃ মোঃ ইয়াসিন আলী খান
    গ্রাম ও থানা: বাসাইল, জেলা: টাঙ্গাইল।
    টাইপিস্ট। বয়স ১৯৭১ সালে: ২৫ বছর।
    আহমেদ মূসা সম্পাদিত জনগণের মুক্তিযুদ্ধ চেতনার স্বরূপ সন্ধান, পৃষ্ঠা - ১৭৪
    ৪৯. তোমার রাইফেল থেকে বেরিয়ে আসছে জীবন
    তুমি দাও থরো থরো দীপ্ত প্রাণ বেয়নেটে নিহত লাশকে
    তোমার পায়ের শব্দে বাঙলাদেশে ঘনায় ফাল্গুন আর
    ৫৪ হাজার বর্গমাইলের এই বিধ্বস্ত বাগান
    এক সুরে গান গেয়ে ওঠে সাত কোটি বিষন্ন কোকিল
    উৎসঃ হুমায়ুন আজাদ; মুক্তিবাহিনীর জন্য; আবুল হাসনাত সম্পাদিত ‘মুক্তিযুদ্ধেও কবিতা’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত।
    ৫০. পাকিস্তানী শোষণ এবং জুলুম থেকে মুক্তি পাবার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছি। এ ছাড়া পাকিস্তানীরা আমাদের লোকজনদের চাকুরি দিতো না। প্রমোশন দিতো না। একই দেশের দু’টি অংশে দ্রব্য মূল্যের পার্থক্য আমার বিবেকে নাড়া দিতো। বিবেকের তাড়নায় পাকিস্তানী কারাগার থেকে মুক্তি পাবার জন্য মন সবসময় ছটফট করতো।
    আমার ব্যক্তিগত স্বপ্ন ছিলো, আমাদের দেশের জনগণের চাকুরি লাভের সুযোগ সৃষ্টি করা। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখানো। ঘুষ এবং মামার সুপারিশের জোরে যাতে কারো চাকুরি না হয় এবং যোগ্য লোকেরা চাকুরি পায়।
    স্বাধীনতা লাভের পর থেকে আজ পর্যন্ত ঘুরে ফিরে মুষ্টিমেয় লোকই দেশের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হচ্ছেন। তাদের মনগড়া শাসন এবং লুটপাটের কারণে স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে না বা হয়নি।
    উৎসঃ সর্দার মোঃ আবদুল খালেক, মুক্তিযোদ্ধা।
    গ্রাম: মুন্ডপাশা, উজিরপুর, জেলা: বরিশাল।
    শ্রমিক নেতা (মিরপুর সিরামিক)। বয়স ১৯৭১ সালে: ২৫ বছর।
    আহমেদ মূসা সম্পাদিত জনগণের মুক্তিযুদ্ধ চেতনার স্বরূপ সন্ধান, পৃষ্ঠা - ১৭৬
    ৫১. আমিসেই রক্তবিন্দু থেকে সম্মুখের ইতিহাস অবধি
    নিজের রক্তবিন্দুকে প্রবাহিত করে দিতে চাই
    আমি একটি রক্তপাতহীন পৃথিবীর জন্য
    এ মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে
    মর্মঘাতি রক্তপাত করে যেতে চাই।
    উৎসঃ অসীম সাহা; পৃথিবীর সবচেয় মর্মঘাতি রক্তপাত; আবুল হাসনাত সম্পাদিত ‘মুক্তিযুদ্ধেও কবিতা’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত।
    ৫২. পাকিস্তানী মালিকেরা আমাদের ন্যায্য পাওনা দিতো না। আর বিহারী সর্দারেরা কারণে অকারণে আমাদের গালিগালাজ করতো। তাদের খারাপ ব্যহারে মন খারাপ হয়ে যেতো। শেখ মুজিবুর রহমান নির্বাচনের সময় বলেছিলেন মিল কারখানার জাতীয়করণ করে শ্রকিদের মিলের মালিকানা দেবেন, ভালো বেতন ও বোনাস দেবেন। তার কথায় বিশ্বাস করে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিলাম। আওয়ামী লীগ সাধারণ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতাও পেলো। কিন্তু পাকিস্তানীরা আমাদের বিরুদ্ধে তাদের সেনাবাহিনী লেলিয়ে দিল। তাইতো বাধ্য হয়ে আমরা স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র ধরলাম।
    আমি মিলের মালিকানা চাইনি। চেয়েছিলাম ন্যায্য পাওনা, যাতে ছেলেমেয়েদের নিয়ে মোটা কাপড়, মোটা ভাত খেতে পারতে পারি।
    উৎসঃ জয়নাল আবেদীন
    গ্রাম: জেরকাড়, ফেনী সদর, জেলা: ফেনী।
    শ্রমিক, আমিন জুট মিল, চট্টগ্রাম। বয়স ১৯৭১ সালে: ৩০ বছর।
    আহমেদ মূসা সম্পাদিত জনগণের মুক্তিযুদ্ধ চেতনার স্বরূপ সন্ধান, পৃষ্ঠা - ১৭৮
    ৫৩. শুধু তোমার জন্য শুধু
    স্বপ্ন মাতাল রাতে তোমার দু’বাহু ছুঁয়ে দেবার জন্যে
    শুধু গহন অবরোধ থেকে তোমার মুক্তির জন্যে
    শুধু লোহিত সেগুন বন তার মরণ চিৎকারে কাঁপে
    আঠালো মাটির বাঙ্কারে
    উৎসঃ মাহবুব সাদিক; যুদ্ধ ভাসমান; আবুল হাসনাত সম্পাদিত ‘মুক্তিযুদ্ধেও কবিতা’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত।
    ৫৪. ৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিব একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও পাকিস্তানীরা ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। অর্থাৎ পাকিস্তানীরা ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে চেয়েছিল, তাই দেশকে মুক্ত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম।
    দেশ স্বাধীন হলে একটা চাকুরি পাবো। ছেলেমেয়েদের নিয়ে সুখে থাকবো। এটাই ছিলো আমার ব্যক্তিগত স্বপ্ন।
    উৎসঃ সাহেব আলী, মুক্তিযোদ্ধা।
    গ্রাম: ইউলিয়া পাড়া, থানা ও জেলা: কিশোরগঞ্জ।
    শ্রমিক, আমিন জুট মিল, চট্টগ্রাম। বয়স ১৯৭১ সালে: ৩৮ বছর।
    আহমেদ মূসা সম্পাদিত জনগণের মুক্তিযুদ্ধ চেতনার স্বরূপ সন্ধান, পৃষ্ঠা - ১৭৮
    ৫৫. চৌদিকে গোরায় দন্ড: মন্ত্রতন্ত্রে লুকানো প্রদীপ
    ঘাতের মুঠোয় জ্বালে। বারুদের নুঘামী ঘ্রাণে
    সৃষ্টির আরেক আলো পৌঁছে যায় সর্ব চরাচরে
    রন্ধ্রে রন্ধ্রে জেগে ওঠে প্রাণ
    উৎসঃ হাবিবুল্লাহ্ সিরাজী; যুদ্ধ; আবুল হাসনাত সম্পাদিত ‘মুক্তিযুদ্ধেও কবিতা’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত।
    ৫৬. পাকিস্তানী স্বৈরশাসন এবং শোষণ থেকে মুক্তি লাভই ছিলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এছাড়া ভাষা আন্দোলন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে এবং চাকুরি ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে পাকিস্তানীদের একচ্ছত্র আধিপত্য ও বৈষম্যমূলক আচরণ মুক্তিযুদ্ধের অংশগ্রহণে প্রেরণা যুগিয়েছিল।
    উৎসঃ মোঃ বোরহান উদ্দিন, মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যকারী।
    গ্রাম: কুমার খোলা, মতলব, জেলা: চাঁদপুর।
    কম্পউন্ডার। বয়স ১৯৭১ সালে: ২২ বছর।
    আহমেদ মূসা সম্পাদিত জনগণের মুক্তিযুদ্ধ চেতনার স্বরূপ সন্ধান, পৃষ্ঠা - ১৭৮
    ৫৭. একটি চুম্বন থেকে ফুটেছে কমল কাঁচা হলুদের আলো
    আঁচলের গিট বাধা পাই। বড় হতে হতে। চাঁদ হয়ে গ্যালো
    তেজা মৃত্তিকার বুকে খুঁটিগেঁথে বসলো প্রাসাদ
    ভালোবাসা স্বাধীনতা পেলো
    আগুন পানির সোনা রুপা নিয়ে তৈরি হলো মানুষের সুখ-দুঃখ।
    উৎসঃ সানাউল হক খান; খোকন খোকন করি মায়; আবুল হাসনাত সম্পাদিত ‘মুক্তিযুদ্ধেও কবিতা’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত।
    ৫৮. একাদশ শ্রেণীর ছাত্র হিসাবে আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। তখন স্বাধীনতা যুদ্ধকে ঘিরে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম। স্বপ্ন ছিল দেশ স্বাধীন হবে, ৬ আনা দিস্তা কাগজে লিখতে পারব, ২০ টাকা মন চাউল কিনতে পারব এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণের সকল ভেদাভেদ ভুলে একই বাঙালী চেতনা নিয়ে বসবাস করতে পারব। দেশেশোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠালগ্নে একটা স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা পাব আর স্বাধীনতার ইতিহাসকে সঠিক ও নির্ভুলভাবে ধারণ করে বেঁচে থাকবো। কেবলমাত্র ভৌগোলিক স্বাধীনতা, পতাকা ও জাতীয় সংগীতের নিছক পরিবর্তন স্বাধীনতার স্বপ্ন ছিল না। ভেবেছিলাম, পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশে বুক ফুলিয়ে সাহসের সাথে ও বিশ্বের দরবারে কথা বলতে পারব। স্বপ্ন ছিল লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত স্বাধীনতার পর কোনো বিশ্বাসঘাতকের জন্ম হবে না।
    উৎসঃ মুহম্মদ শফিউদ্দিন ভূঁইয়া
    গ্রাম: বারমদী, থানা: সোনারগাঁও। জেলা: নারায়ণগঞ্জ।
    এডভোকেট। বয়স ১৯৭১ সালে ১৭ বছর।
    আহমেদ মূসা সম্পাদিত জনগণের মুক্তিযুদ্ধ চেতনার স্বরূপ সন্ধান, পৃষ্ঠা - ১৮০
    ৫৯. শাশ্বত শান্তির যারা তারাও যুদ্ধে আসে
    অবশ্য আসতে হয় মাঝে মধ্যে
    অস্তিত্বের প্রগাঢ় যুদ্ধবাজ হয়ে যায় মোহরের প্রিয় প্রলোভনে
    উৎসঃ হেলাল হাফিজ; নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়; আবুল হাসনাত সম্পাদিত ‘মুক্তিযুদ্ধেও কবিতা’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত।
    ৬০. দেশ স্বাধীন হবে। দেশের লোক সুখে-শান্তিতে থাকবে, আমাদের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখে চাকুরি পাবে এটাই ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনা।
    দেশ স্বাধীন হলে আমাদের আর্থিক উন্নতি ঘটবে। ভালোভাবে চলতে পারবো এবং কোনো অভাব অভিযোগ থাকবে না। এটা ছিল আমার ব্যক্তিগত স্বপ্ন।
    উৎসঃ আফসার আলী, মুক্তিযোদ্ধা।
    গ্রাম: একডালা, সিরাজগঞ্জ বাজার। থানা ও জেলা: সিরাগঞ্জ।
    করণিক। বয়স ১৯৭১ সালে: ২৫ বছর।
    আহমেদ মূসা সম্পাদিত জনগণের মুক্তিযুদ্ধ চেতনার স্বরূপ সন্ধান, পৃষ্ঠা - ১৮১
    ৬১. বলো আমিও কি নিশ্চিত জানি রক্তজবাদের লাল ক্রোধের
    ভেতর থেকে একদিন বাতাসে উড়েছিলো
    তোমার এবং আমাদের সকলের অস্থি ও পতাকা?
    শিশু এবং রক্ত জবাদের আচরণে খুব মিল ছিলো বাংলার
    পশ্চিমের নিষ্পাপ পূর্ণাঙ্গ ভ্রূণের মতো আমাদের শিশুরা
    জোৎস্না রাতে কিংবা ভোরের উপমা নয়
    জরায়ুতে শিশুর চিৎকারে ছিঁড়ে গেছে মাতৃযোনি
    উৎসঃ শিহাব সরকার; টুকরা টুকরা জ্বলন্ত অঙ্গার; আবুল হাসনাত সম্পাদিত ‘মুক্তিযুদ্ধেও কবিতা’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত।
    ৬২. পাকিস্তানী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার ছিলাম আমরা। আমাদের প্রতি তাদের বৈষম্যমূলক আচরণ এবং প্রশাসনিক নির্যাতন আমার মধ্যে স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনা হিসেবে কাজ করেছে। জনগণের উন্নয়ন, মুক্তি এবং ন্যায়প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি।
    সুখী সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়ে তোলাই ছিলো আমার ব্যক্তিগত স্বপ্ন। আমি মনে করেছি, দেশের উন্নতি হলে সবাই সুখী হবে। সেই সঙ্গে আমার ভাগ্যের পরিবর্তন হবে।
    যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বা যে স্বপ্নকে সামনে নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম আমার দৃষ্টিতে তা আদৌ বাস্তবায়িত হয়নি। আমরা ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জন করলেও স্বাধীনতার মূলভিত্তি অর্থনৈতিক মুক্তিলাভ করতে পারিনি। লক্ষ্য ও আদর্শবিহীন রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের কারণে তা সম্ভব হয়ে উঠেনি। সর্বোপরি স্বাধীনতাত্তোরকালের নৈতিক-চরিত্রহীন রাজনৈতিক নেতৃত্বে এবং প্রশাসন আমাদের সকল স্বপ্ন দুমড়ে মুচড়ে তছনছ করে দিয়েছে।
    উৎসঃ জয়নাল আবেদীন, মুক্তিযোদ্ধা।
    গ্রাম: মাহিগঞ্জ, ভুরুঙ্গামারী, কুড়িগ্রাম।
    করণিক, বাংলাদেশ ব্যাংক। বয়স ১৯৭১ সালে: ২১ বছর।
    আহমেদ মূসা সম্পাদিত জনগণের মুক্তিযুদ্ধ চেতনার স্বরূপ সন্ধান, পৃষ্ঠা - ১৮১
    ৬৩. এখন আমার চারদিকে যুদ্ধময় দহনের দীর্ঘতম সেতু
    পোড়া লাশের উৎকট গন্ধ
    সেই আমি আমার মাকে খুঁজে পাই
    অবরুদ্ধ আমার মা
    তবুও আমি মুক্ত দস্যি দামাল মুক্তিযোদ্ধা
    স্বাধীনতাকামী এক সুসভ্য পৃথিবীর অধিবাসী
    উৎসঃ শাকিল কালাম; সরাসরি-সংগ্রহ
    ৬৪. বাবুই পাখি যেমন নিজের বাসা নিজেই গড়ে সেভাবে আমিও নিজের ভাগ্য নিজেই গড়বো। আর পাকিস্তানী কুত্তাদের কিলঘুষি খেতে হবে না। সব জিনিসের দাম কমে যাবে, সুখে, শান্তিতে থাকতে পরবো। ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখতে পারবে এবং মানুষের মতো মানুষ হবে।
    উৎসঃ সৈয়দ হোসেন
    গ্রাম: তুলাতলি, চন্দনপুর। হোমনা, কুমিল্লা।
    রিক্সাচালক। বয়স ১৯৭১ সালে: ৩৮ বছর
    আহমেদ মূসা সম্পাদিত জনগণের মুক্তিযুদ্ধ চেতনার স্বরূপ সন্ধান, পৃষ্ঠা - ১৮৩
  • 0 comments:

    Post a Comment

    New Research

    Attention Mechanism Based Multi Feature Fusion Forest for Hyperspectral Image Classification.

    CBS-GAN: A Band Selection Based Generative Adversarial Net for Hyperspectral Sample Generation.

    Multi-feature Fusion based Deep Forest for Hyperspectral Image Classification.

    ADDRESS

    388 Lumo Rd, Hongshan, Wuhan, Hubei, China

    EMAIL

    contact-m.zamanb@yahoo.com
    mostofa.zaman@cug.edu.cn

    TELEPHONE

    #
    #

    MOBILE

    +8615527370302,
    +8807171546477